ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড এখন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে এসেছে। ডিজিটাল এই যুগে প্রযুক্তি আমাদেরকে অনেক কিছুই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমনি আমাদের জীবন যাত্রা সহজ হচ্ছে। তেমনি দুষ্কৃতিকারীরাও প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও স্মার্ট হচ্ছে। ফলে বাড়ছে জালিয়াতি।
বিশেষ করে আর্থিক খাতে জাতিয়ালির চেষ্টা সবচেয়ে বেশি। তাই আপনার ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে একটু সতর্ক না হলে ঘটতে পারে বড় ধরনের বিপত্তি। বিভিন্ন ব্যাংক সময়ে সময়ে আপনাকে সতর্ক করছে। তারপরেও অনেক সময়ে ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ইউজাররা সামান্য অবহেলা করে দূর্ঘটনায় পতিত হচ্ছেন।
সূচীপত্র
- ১. ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের পার্থক্য বোঝা
- ২. ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারকারীর প্রোফাইল
- ৩. বিল পরিশোধের সময়সীমা মেনে চলুন
- ৪. ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- ৫. ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের এটিএম চার্জ সম্পর্কে জানুন
- ৬. অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
- ৭. ডেবিট ক্রেডিট কার্ড ফ্রড সম্পর্কে সচেতন থাকুন
- ৮. ক্যাশব্যাক এবং রিওয়ার্ড পয়েন্টগুলির সদ্ব্যবহার করুন
- ৯. ঋণগ্রস্ত হওয়া থেকে বিরত থাকুন
- ১০. ডেবিট ক্রেডিট কার্ড লিমিট বুঝে ব্যয় করুন
- ১১. মাসিক ব্যয়ের পরিকল্পনা করুন
- ১২. মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন ট্র্যাক করুন
- ১৩. অ্যাপল পে বা গুগল পে ব্যবহার করুন
- ১৪. ভ্রমণের সময় সতর্ক থাকুন
- ১৫. এটিএম পিন নিরাপদ রাখুন
- উপসংহার
১. ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের পার্থক্য বোঝা
ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো কিভাবে অর্থ ব্যবহৃত হয়। ডেবিট কার্ড আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সংযুক্ত, এবং আপনি যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেন তা সরাসরি আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা হয়। অন্যদিকে, ক্রেডিট কার্ড আপনাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ দেয়, যা আপনি পরে পরিশোধ করতে পারেন। ডেবিট কার্ডে তাৎক্ষণিক লেনদেন সম্পন্ন হয়, যেখানে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ থাকে।
২. ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারকারীর প্রোফাইল
ডেবিট কার্ড ব্যবহারকারীদের জন্য:
- লো-ব্যালেন্স ট্র্যাকিং: ডেবিট কার্ড সাধারণত সেই ব্যবহারকারীদের জন্য উপযুক্ত যারা তাদের ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মধ্যে কতটা টাকা আছে তা সবসময় নজরে রাখা জরুরি, কারণ এটি সীমিত তহবিলের ওপর নির্ভর করে।
- নগদহীন কেনাকাটা: যারা নগদ টাকা সঙ্গে রাখতে চান না তাদের জন্য ডেবিট কার্ড একটি আদর্শ সমাধান। এটি আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের টাকায় সরাসরি কেনাকাটা করতে সক্ষম করে।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের জন্য:
- ক্রেডিট স্কোর বৃদ্ধি: যদি আপনি সঠিকভাবে এবং সময়মতো ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করেন, তবে এটি আপনার ক্রেডিট স্কোর বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। এটি ভবিষ্যতে বড় ঋণ নেওয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
- রিওয়ার্ড পয়েন্ট এবং ক্যাশব্যাক: বেশিরভাগ ক্রেডিট কার্ড সংস্থাগুলি বিভিন্ন ধরনের রিওয়ার্ড পয়েন্ট এবং ক্যাশব্যাক অফার করে, যা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের একটি বাড়তি সুবিধা।
৩. বিল পরিশোধের সময়সীমা মেনে চলুন
ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সময়মতো বিল পরিশোধ করা। সময়মতো বিল পরিশোধ না করলে সুদের হার বেড়ে যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে ঋণগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। তাই, আপনার মাসিক ব্যয় নজরে রাখুন এবং সময়মতো আপনার ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করুন। অনেক সংস্থা বিল পরিশোধের তারিখ মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এসএমএস এবং ইমেইল অ্যালার্ট প্রদান করে, সেগুলি ব্যবহার করুন।
৪. ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখুন
ক্রেডিট কার্ডের একটি সাধারণ সমস্যা হলো আপনি সহজেই বেশি খরচ করে ফেলতে পারেন। এটি আপনার বাজেটের ওপর একটি বিরাট চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই, আপনি যে পরিমাণ টাকা খরচ করতে ইচ্ছুক তার একটি নির্দিষ্ট সীমা স্থির করুন এবং সেই অনুযায়ী ব্যয় করুন। বাজেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনি বিভিন্ন ফিনান্স ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন।
৫. ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের এটিএম চার্জ সম্পর্কে জানুন
ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে আপনার ব্যাংক আপনাকে সীমিত সংখ্যক বিনামূল্যে এটিএম লেনদেনের সুবিধা দেয়। এরপর থেকে প্রতিটি লেনদেনের জন্য চার্জ প্রযোজ্য হয়। তাই ডেবিট কার্ড ব্যবহারে খরচ কমাতে আপনাকে এটি মাথায় রাখতে হবে। এছাড়া, অন্য ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তোলার জন্য অতিরিক্ত চার্জ প্রযোজ্য হতে পারে। আপনার ব্যাংকের নীতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে রাখুন।
৬. অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সময় সর্বদা অনলাইন নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। নিম্নলিখিত কয়েকটি পদক্ষেপ অনুসরণ করে আপনি আপনার লেনদেনকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন:
- নিরাপদ ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন: যেকোনো লেনদেন করার আগে নিশ্চিত করুন যে ওয়েবসাইটটি সুরক্ষিত (URL-এ “https” দেখতে পাবেন)।
- ভুল স্থান থেকে শপিং এড়িয়ে চলুন: কম পরিচিত বা অবিশ্বস্ত ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটা করবেন না। শুধুমাত্র স্বীকৃত এবং বিশ্বস্ত সাইটগুলোতে লেনদেন করুন।
- দুটি ধাপের যাচাই (2FA) ব্যবহার করুন: আপনি যদি অনলাইন লেনদেন করেন, তাহলে দুটি ধাপের যাচাই ব্যবস্থা চালু করে নিন। এতে আপনার লেনদেন আরও নিরাপদ হবে।
- অনলাইনে কার্ডের তথ্য সংরক্ষণ করবেন না: অনেক ই-কমার্স সাইট আপনার কার্ডের তথ্য সংরক্ষণ করার প্রস্তাব দিতে পারে, কিন্তু তা করবেন না। কার্ডের তথ্য সংরক্ষণের পরিবর্তে, প্রতিবার কেনাকাটার সময় নিজে থেকে তথ্য প্রদান করুন।
৭. ডেবিট ক্রেডিট কার্ড ফ্রড সম্পর্কে সচেতন থাকুন
ক্রেডিট কার্ড ফ্রড বর্তমান সময়ে একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় অপরাধীরা আপনার ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করে সেটি ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন:
- অস্বাভাবিক লেনদেন খেয়াল করুন: নিয়মিতভাবে আপনার ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের বিবরণ চেক করুন। যদি আপনি কোনো অস্বাভাবিক বা অচেনা লেনদেন দেখতে পান, সঙ্গে সঙ্গে আপনার ব্যাঙ্ক বা কার্ড প্রদানকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করুন।
- পাবলিক ওয়াই-ফাই থেকে কেনাকাটা করবেন না: পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে অনলাইন কেনাকাটা বা ব্যাংকিং করবেন না। অপরাধীরা এই ধরনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সহজেই আপনার তথ্য চুরি করতে পারে।
- অ্যাকাউন্টের সতর্কবার্তা চালু করুন: অনেক ব্যাঙ্ক ও ক্রেডিট কার্ড সংস্থা একটি সতর্কবার্তা ব্যবস্থা প্রদান করে, যা আপনাকে প্রতিটি লেনদেনের পরে এসএমএস বা ইমেইলের মাধ্যমে সতর্ক করে।
৮. ক্যাশব্যাক এবং রিওয়ার্ড পয়েন্টগুলির সদ্ব্যবহার করুন
যদি আপনি নিয়মিতভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, তবে আপনি বিভিন্ন ক্যাশব্যাক ও রিওয়ার্ড পয়েন্ট জমাতে পারেন। এই পয়েন্টগুলি পরবর্তীকালে কেনাকাটা বা অন্যান্য সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। তবে রিওয়ার্ড পয়েন্টগুলি সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্য তাদের শর্তাবলী ভালোভাবে বুঝে নিন, কারণ অনেক ক্ষেত্রে এগুলির মেয়াদ থাকতে পারে।
৯. ঋণগ্রস্ত হওয়া থেকে বিরত থাকুন
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপনি খুব সহজেই ঋণগ্রস্ত হতে পারেন যদি আপনি সময়মতো বিল পরিশোধ না করেন। তাই কার্ড ব্যবহারে সর্বদা সতর্ক থাকুন এবং যতটা সম্ভব ধার বা ঋণ না নেয়ার চেষ্টা করুন। বেশি ব্যয় করলে তা নিয়মিত পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা আপনার আর্থিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
১০. ডেবিট ক্রেডিট কার্ড লিমিট বুঝে ব্যয় করুন
ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডে লিমিটের একটি বড় ভূমিকা থাকে। ডেবিট কার্ডের ক্ষেত্রে আপনি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা থাকা টাকার মধ্যেই ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে, ব্যাংক বা সংস্থা আপনাকে একটি নির্দিষ্ট ঋণসীমা দেয়। এই সীমা বুঝে এবং তার ভেতরেই ব্যয় করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, যাতে আপনার ওপর বাড়তি ঋণ চাপে না।
১১. মাসিক ব্যয়ের পরিকল্পনা করুন
ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাসিক বাজেটের একটি পরিকল্পনা থাকা জরুরি। আপনি কতটুকু ব্যয় করবেন, কোথায় ব্যয় করবেন এবং কখন এই ব্যয়টি পরিশোধ করবেন তার একটি স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। অনেক সময়, কার্ড ব্যবহারে অপ্রয়োজনীয় খরচ বৃদ্ধি পায় যা মাস শেষে বড় অঙ্কে রূপ নিতে পারে।
১২. মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন ট্র্যাক করুন
বর্তমান ডিজিটাল যুগে আপনার ব্যাঙ্ক বা কার্ড প্রদানকারী সংস্থার মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে আপনি সহজেই আপনার লেনদেনগুলি ট্র্যাক করতে পারেন। এই অ্যাপগুলির মাধ্যমে আপনি ব্যালেন্স চেক করতে, লেনদেনের নোটিফিকেশন পেতে এবং বিল পরিশোধ করতে পারবেন। এছাড়া, কোনো অস্বাভাবিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
১৩. অ্যাপল পে বা গুগল পে ব্যবহার করুন
যদি আপনি আরও নিরাপদ ও সুবিধাজনক উপায়ে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে চান, তবে অ্যাপল পে বা গুগল পের মতো মোবাইল পেমেন্ট সেবা ব্যবহার করতে পারেন। এগুলি কার্ডের তথ্য সরাসরি ব্যবহার না করে একটি এনক্রিপ্টেড টোকেনের মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করে, যা আপনার কার্ডের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে।
১৪. ভ্রমণের সময় সতর্ক থাকুন
বিদেশ ভ্রমণের সময় ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে অতিরিক্ত ফি প্রযোজ্য হয়। তাই ভ্রমণের আগে আপনার কার্ডের বৈশিষ্ট্য ও ফি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এবং বিদেশে যাওয়ার আগে কার্ড প্রদানকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে নিন।
১৫. এটিএম পিন নিরাপদ রাখুন
আপনার ডেবিট ক্রেডিট কার্ডের পিন কোড সবসময় সুরক্ষিত রাখুন। কারও সাথে শেয়ার করবেন না এবং পিন পরিবর্তন করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটিএমে টাকা তোলার সময় সতর্ক থাকুন যাতে অন্য কেউ আপনার পিন না দেখতে পায়।
উপসংহার
ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবে সঠিক ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে না তুললে তা বিপদের কারণ হতে পারে।
(ফলো করুন আমাদের Google News, Facebook এবং Twitter পেজ)
আরও পড়ুন:
মন্তব্য লিখুন